লেখক পরিচিতি
বিঙ্কমচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায় ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দের ২৬এ জুন (১৩ই আষাঢ় ১২৪৫ বঙ্গাব্দ)
পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা ভাষার
প্রথম শিল্পসম্মত উপন্যাস রচনার কৃতিত্ব তাঁরই। তাঁর পিতা যাদবচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর।
১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ
প্রথম স্নাতকদের মধ্যে তিনি একজন। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট।
এ চাকরিসূত্রে খুলনায় ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করে তিনি নীলকরদের
অত্যাচার দমন করেছিলেন। দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান, যোগ্য বিচারক
হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। বাংলা সাহিত্যচর্চার অসাধারণ সাফল্য অর্জন
করেছিলেন তিনি। উপন্যাস ও প্রবন্ধ রচনার বাইরে ‘বঙ্গদর্শন’ (১৮৭২) পত্রিকা
সম্পাদনা ও প্রকাশ তাঁর অন্যতম কীর্তি।
১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে ‘সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে তাঁর
সাহিত্যচর্চার শুরু। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গ্রন্থসংখ্যা ৩৪। তাঁর
রচিত প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাস
হলো : কপালকুণ্ডলা, মৃণালিনী, বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল ইন্দিরা,
যুগলাঙ্গুরীয়, আনন্দমঠ, চন্দশেখর, রাধারাণী, রজনী, সীতারাম, দেবী চৌধুরাণী,
রাজসিংহ। ‘Rajmohons Wife’ নামে একটি ইংরেজি উপন্যাসও তিনি রচনা করেছেন।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, ভাষা ও সামাজবিষয়ক অনেক
প্রবন্ধ রচনা করেছেন। লোকরহস্য, বিজ্ঞানরহস্য, কমলাকান্তের দপ্তর, সাম্য,
কৃষ্ণচরিত্র, বিবিধ প্রবন্ধ ইত্যাদি তাঁর গদ্যগ্রন্থ। বাংলা সাহিত্যে
অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ‘সাহিত্যসম্রাট’ উপাধিতে ভূষিত হন।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ৮ই এপ্রিল কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
মূলরচনা-১
আমি
শয়নগৃহে, চারপায়ীর উপর বসিয়া, হুঁকা হাতে ঝিমাইতেছিলাম। একটু মিটমিট করিয়া
ক্ষুদ্র আলো জ্বলিতেছে-দেয়ালের উপর চঞ্চল ছায়া, প্রেতবৎ নাচিতেছে। আহার
প্রস্তুত হয় নাই-এজন্য হুঁকা হাতে, নিমীলিতলোচনে আমি ভাবিতেছিলাম যে, আমি
যদি নেপোলিয়ন হইতাম তবে ওয়াটার্লু জিতিতে পারিতাম কি না। এমত সময়ে একটি
ক্ষুদ্র শব্দ হইল, ‘মেও’! চাহিয়া দেখিলাম-হঠাৎ কিছু বুঝিতে পারিলাম না।
প্রথমে মনে হইল, ওয়েলিংটন হঠাৎ বিড়ালত্ব প্রাপ্ত হইয়া আমার নিকট আফিং
ভিক্ষা করিতে আসিয়াছে। প্রথম উদ্যমে, পাষাণবৎ কঠিন হইয়া, বলিব মনে করিলাম
যে, ডিউক মহাশয়কে ইতোপূর্র্বে যথোচিত পুরস্কার দেওয়া গিয়াছে, এক্ষণে আর
অতিরিক্ত পুরস্কার দেওয়া যাইতে পারে না। বিশেষ অপরিমিত লোভ ভালো নহে। ডিউক
বলিল, ‘মেও’!
মূলরচনা-২
তখন
চক্ষু চাহিয়া ভালো করিয়া দেখিলাম যে, ওয়েলিংটন নহে। একটি ক্ষুদ্র মার্জার;
প্রসন্ন আমার জন্য যে দুগ্ধ রাখিয়া গিয়াছিল, তাহা নিঃশেষ করিয়া উদরসাৎ
করিয়াছে, আমি তখন ওয়াটার্লুর মাঠে ব্যূহ-রচনায় ব্যস্ত, অত দেখি নাই। এক্ষণে
মার্জারসুন্দরী, নির্জল দুগ্ধপানে পরিতৃপ্ত হইয়া আপন মনের সুখ এ জগতে
প্রকটিত করিবার অভিপ্রায়ে, অতি মধুর স্বরে বলিতেছেন, ‘মেও’! বলিতে পারি না,
বুঝি তাহার ভিতর একটু ব্যঙ্গ ছিল; বুঝি, মার্জার মনে মনে হাসিয়া আমার পানে
চাহিয়া ভাবিতেছিল, ‘কেহ মনের বিল ছেঁচে, কেহ খায় কই’। বুঝি সে ‘মেও’!
শব্দে একটু মন বুঝিবার অভিপ্রায় ছিল। বুঝি বিড়ালের মনের ভাব, ‘তোমার দুধ ত
খাইয়া বসিয়া আছি-এখন বল কী’?
মূলরচনা-৩
বলি
কী? আমি তো ঠিক করিতে পারিলাম না। দুধ আমার বাপেরও নয়। দুধ মঙ্গলার,
দুহিয়াছে প্রসন্ন। অতএব সে দুগ্ধে আমারও যে অধিকার, বিড়ালেরও তাই। সুতরাং
রাগ করিতে পারি না। তবে চিরাগত একটি প্রথা আছে যে, বিড়ালে দুধ খাইয়া গেলে,
তাহাকে তাড়াইয়া মারিতে যাইতে হয়। আমি যে সেই চিরাগত প্রথার অবমাননা করিয়া
মনুষ্যকুল কুলাঙ্গার স্বরূপ পরিচিত হইব, ইহাও বাঞ্ছনীয় নহে। কী জানি, এই
মার্জারী যদি স্বজাতিমণ্ডলে কমলাকান্তকে কাপুরুষ বলিয়া উপহাস করে? অতএব
পুরুষের ন্যায় আচরণ করাই বিধেয়। ইহা স্থির করিয়া, সকাতরচিত্তে, হস্ত হইতে
হুঁকা নামাইয়া, অনেক অনুসন্ধানে এক ভগ্ন যষ্টি আবি®কৃত করিয়া সগর্বে
মার্জারীর প্রতি ধাবমান হইলাম।
মূলরচনা-৪
মার্জারী
কমলাকান্তকে চিনিত; সে যষ্টি দেখিয়া বিশেষ ভীত হওয়ার কোনো লক্ষণ প্রকাশ
করিল না। কেবল আমার মুখপানে চাহিয়া হাই তুলিয়া, একটু সরিয়া বসিল। বলিল,
‘মেও’! প্রশ্ন বুঝিতে পারিয়া যষ্টি ত্যাগ করিয়া পুনরপি শয্যায় আসিয়া হুঁকা
লইলাম। তখন দিব্যকর্ণ প্রাপ্ত হইয়া, মার্জারের বক্তব্যসকল বুঝিতে পারিলাম।
বুঝিলাম যে, বিড়াল বলিতেছে, মারপিট কেন? স্থির হইয়া, হুঁকা হাতে করিয়া,
একটু বিচার করিয়া দেখ দেখি? এ সংসারের ক্ষীর, সর, দুগ্ধ, দধি, মৎস্য, মাংস
সকলই তোমরা খাইবে, আমরা কিছু পাইব না কেন? তোমরা মনুষ্য, আমরা বিড়াল,
প্রভেদ কী? তোমাদের ক্ষুৎপিপাসা আছে- আমাদের কি নাই? তোমরা খাও, আমাদের
আপত্তি নাই কিন্তু আমরা খাইলেই তোমরা কোন শাস্ত্রানুসারে ঠেঙ্গা লাঠি লইয়া
মারিতে আইস, তাহা আমি বহু অনুসন্ধানে পাইলাম না। তোমরা আমার কাছে কিছু
উপদেশ গ্রহণ কর। বিজ্ঞ চতুষ্পদের কাছে শিক্ষালাভ ব্যতীত তোমাদের
জ্ঞানোন্নতির উপায়ান্তর দেখি না। তোমাদের বিদ্যালয় সকল দেখিয়া আমার বোধ হয়,
তোমরা এত দিনে এ কথাটি বুঝিতে পারিয়াছ।
মূলরচনা-৫
দেখ,
শয্যাশায়ী মনুষ্য! ধর্ম কী? পরোপকারই পরম ধর্ম। এই দুগ্ধটুকু পান করিয়া
আমার পরম উপকার হইয়াছে। তোমার আহরিত দুগ্ধে এই পরোপকার সিদ্ধ হইল-অতএব তুমি
সেই পরম ধর্মের ফলভাগী-আমি চুরিই করি, আর যাই করি, আমি তোমার ধর্মসঞ্চয়ের
মূলীভূত কারণ। অতএব আমাকে প্রহার না করিয়া, আমার প্রশংসা কর। আমি তোমার
ধর্মের সহায়। দেখ, ‘আমি চোর বটে কিন্তু আমি কি সাধ করিয়া চোর হইয়াছি? খাইতে
পাইলে কে চোর হয়? দেখ, যাঁহারা বড় বড় সাধু, চোরের নামে শিহরিয়া উঠেন,
তাঁহারা অনেকে চোর অপেক্ষাও অধার্মিক।’ তাঁহাদের চুরি করিবার প্রয়োজন নাই
বলিয়াই চুরি করেন না। কিন্তু তাঁহাদের প্রয়োজনাতীত ধন থাকিতেও চোরের প্রতি
যে মুখ তুলিয়া চাহেন না, ইহাতেই চোরে চুরি করে। অধর্ম চোরের নহে- চোরে যে
চুরি করে, সে অধর্ম কৃপণ ধনী। চোর দোষী বটে কিন্তু কৃপণ ধনী তদপেক্ষা শত
গুণে দোষী। চোরের দণ্ড হয়; চুরির মূল যে কৃপণ, তাহার দণ্ড হয় না কেন?
মূলরচনা-৬
দেখ,
আমি প্রাচীরে প্রাচীরে মেও মেও করিয়া বেড়াই, কেহ আমাকের মাছের কাঁটাখানাও
ফেলিয়া দেয় না। মাছের কাঁটা, পাতের ভাত, নরদমায় ফেলিয়া দেয়, জলে ফেলিয়া
দেয়। তথাপি আমাকে ডাকিয়া দেয় না। তোমাদের পেট ভরা, আমার পেটের ক্ষুধা কী
প্রকারে জানিবে! হায়! দরিদ্রের জন্য ব্যথিত হইলে তোমাদের কি কিছু অগৌরব
আছে? আমার মতো দরিদ্রের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া, লজ্জার কথা সন্দেহ নাই। যে
কখনো অন্ধকে মুষ্টি-ভিক্ষা দেয় না, সেও একটা বড় রাজা ফাঁপরে পড়িলে রাত্রে
ঘুমায় না-সকলেই পরের ব্যথায় ব্যথিত হইতে রাজি। তবে ছোটলোকের দুঃখে কাতর!
ছি! কে হইবে?
মূলরচনা-৭
দেখ,
যদি অমুক শিরোমণি, কি অমুক ন্যায়ালংকার আসিয়া তোমার দুধুটুকু খাইয়া
যাইতেন, তবে তুমি কি তাঁহাকে ঠেঙ্গা লইয়া মারিতে আসিতে? বরং জোড়হাত করিয়া
বলিতে, আর একটু কি আনিয়া দিব? তবে আমার বেলা লাঠি কেন? তুমি বলিবে, তাঁহারা
অতি পণ্ডিত, বড় মান্য লোক। পণ্ডিত বা মান্য বলিয়া কি আমার অপেক্ষা
তাঁহাদের ক্ষুধা বেশি? তা তো নয়- তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্যজাতির
রোগ-দরিদ্রের ক্ষুধা কেহ বুঝে না। যে খাইতে বলিলে বিরক্ত হয়, তাহার জন্য
ভোজের আয়োজন করে-আর যে ক্ষুধার জ্বালায় বিনা আহ্বানেই তোমার অন্ন খাইয়া
ফেলে, চোর বলিয়া তাহার দণ্ড কর-ছি! ছি! ‘দেখ, আমাদিগের দশা দেখ, দেখ
প্রাচীরে প্রাচীরে, প্রাঙ্গণে প্রাঙ্গণে প্রাসাদে প্রাসাদে মেও মেও করিয়া
আমরা চারিদিক দৃষ্টি করিতেছি-কেহ আমাদিগকে মাছের কাঁটাখানা ফেলিয়া দেয় না।
যদি কেহ তোমাদের সোহাগের বিড়াল হইতে পারিল- গৃহমার্জার হইয়া, বৃদ্ধের নিকট
যুবতী ভার্যার সহোদর, বা মূর্খ ধনীর কাছে সতরঞ্চ খেলোয়াড়ের স্থানীয় হইয়া
থাকিতে পারিল-তবেই তাহার পুষ্টি। তাহার লেজ ফুলে, গায়ে লোম হয় এবং তাহাদের
রূপের ছটা দেখিয়া, অনেক মার্জার কবি হইয়া পড়ে।
মূলরচনা-৮
‘আর,
আমাদিগের দশা দেখ-আহারাভাবে উদর কৃশ, অস্থি পরিদৃশ্যমান, লাঙ্গুল বিনত,
দাঁত বাহির হইয়াছে-জিহ্বা ঝুলিয়া পরিয়াছে-অবিরত আহারাভাবে ডাকিতেছি, ‘মেও!
মেও! খাইতে পাই না!’- আমাদের কালো চামড়া দেখিয়া ঘৃণা করিও না! এ পৃথিবীর
মৎস মাংসে আমাদের কিছু অধিকার আছে। খাইতে দাও-নহিলে চুরি করিব। আমাদের
কৃষ্ণ চর্ম, শুষ্ক মুখ, ক্ষীণ সকরুণ মেও মেও শুনিয়া তোমাদিগের কি দুঃখ হয়
না? চোরের দণ্ড আছে, নির্দয়তার কি দণ্ড নাই? দরিদ্রের আহার সংগ্রহের দণ্ড
আছে, ধনীর কার্পণ্যের দণ্ড নাই কেন? তুমি কমলাকান্ত, দূরদর্শী, কেন না
আফিংখোর, তুমিও কি দেখিতে পাও না যে ধনীর দোষেই দরিদ্রে চোর হয়? পাঁচ শত
দরিদ্রকে বঞ্চিত করিয়া একজনে পাঁচশত লোকের আহার্য সংগ্রহ করিবে কেন? যদি
করিল, তবে সে তাহার খাইয়া যাহা বাহিয়া পড়ে, তাহা দরিদ্রকে দিবে না কেন? যদি
না দেয়, তবে দরিদ্র অবশ্য তাহার নিকট হইতে চুরি করিবে। কেননা অনাহারে
মরিয়া যাইবার জন্য এ পৃথিবীতে কেহ আইসে নাই।’
মূলরচনা-৯
আমি
আর সহ্য করিতে না পারিয়া বলিলাম, ‘থাম! থাম মার্জারপণ্ডিতে! তোমার কথাগুলি
ভারি সোশিয়ালিস্টিক! সমাজ বিশৃঙ্খলার মূল! যদি যাহার যত ক্ষমতা, সে তত
ধনসঞ্চয় করিতে না পায়, অথবা সঞ্চয় করিয়া চোরের জ্বালায় নির্বিঘ্নে ভোগ
করিতে না পায়, তবে কেহ আর ধনসঞ্চয়ে যত্ন করিবে না। তাহাতে সমাজের ধনবৃদ্ধি
হইবে না।‘ মার্জার বলিল, না হাইলে ত আমার কী? সমাজের ধনবৃদ্ধির অর্থ ধনীর
ধনবৃদ্ধি। ধনীর ধনবৃদ্ধি না হইলে দরিদ্রের কী ক্ষতি? আমি বুঝাইয়া বলিলাম
যে, ‘সামাজিক ধনবৃদ্ধি ব্যতীত সমাজের উন্নতি নাই’ বিড়াল রাগ করিয়া বলিল যে,
‘আমি যদি খাইতে না পাইলাম, তবে সমাজের উন্নতি লইয়া কী করিব?’
মূলরচনা-১০
বিড়ালকে
বুঝান দায় হইল। যে বিচারক বা নৈয়ায়িক, কস্মিনকালে কেহ তাহাকে কিছু বুঝাইতে
পারে না। এ মার্জার সুবিচারক এবং সুতার্কিকও বটে, সুতরাং না বুঝিবার পক্ষে
ইহার অধিকার আছে। অতএব ইহার উপর রাগ না করিয়া বলিলাম, ‘সমাজের উন্নতিতে
দরিদ্রের প্রয়োজন না থাকিলে না থাকিতে পারে কিন্তু ধনীদিগের বিশেষ প্রয়োজন।
অতএব চোরে দণ্ডবিধান কর্তব্য। মার্জারী মহাশয় বলিলেন, চোরকে ফাঁসি দাও,
তাহাতেও আমার আপত্তি নাই কিন্তু তাহার সঙ্গে আর একটি নিয়ম কর। যে বিচারক
চোরকে সাজা দিবেন, তিনি আগে তিন দিবস উপবাস করিবেন। তাহাতে যদি তাঁহার চুরি
করিয়া খাইতে ইচ্ছা না করে, তবে তিনি স্বচ্ছন্দে চোরকে ফাঁসি দিবেন। তুমি
আমাকে মারিতে লাঠি তুলিয়াছিলে, তুমি অদ্য হইতে তিন দিবস উপবাস করিয়া দেখ।
তুমি যদি ইতিমধ্যে নসীরাম বাবুর ভাণ্ডারঘরে ধরা না পড় তবে আমাকে ঠেঙ্গাইয়া
মারিও, আমি আপত্তি করিব না।
মূলরচনা-১১
বিজ্ঞ
লোকের মত এই যে, যখন বিচারে পরাস্ত হইবে, তখন গম্ভীরভাবে উপদেশ প্রদান
করিবে। আমি সেই প্রথানুসারে মার্জারকে বলিলাম যে, ‘এ সকল অতি নীতিবিরুদ্ধ
কথা, ইহার আন্দোলনেও পাপ আছে। তুমি এ সকল দুশ্চিন্তা পরিত্যাগ করিয়া
ধর্মাচরণে মন দাও। তুমি যদি চাহ তবে পাঠার্থে তোমাকে আমি নিউমান ও পার্করের
গ্রন্থ দিতে পারি। আর কমলাকান্তের দপ্তর পরিলেও কিছু উপকার হইতে পারে-আর
কিছু হউক বা না হউক, আফিঙের অসীম মহিমা বুঝিতে পারিবে। এক্ষণে স্বস্থানে
গমন কর, প্রসন্ন কাল কিছু ছানা দিবে বলিয়াছে, জলযোগের সময় আসিও, উভয় ভাগ
করিয়া খাইব। অদ্য আর কাহারও হাঁড়ি খাইও না বরং ক্ষুধায় যদি নিতান্ত অধীর হও
তবে পুনর্বার আসিও, এক সরিষাভোর আফিং দিব।
মার্জার বলিল, আফিঙের বিশেষ প্রয়োজন নাই তবে হাঁড়ি খাওয়ার কথা,
ক্ষুধানুসারে বিবেচনা করা যাইবে। মার্জার বিদায় হইল। একটি পতিত আত্মাকে
অন্ধকার হইতে আলোকে আনিয়াছি, ভাবিয়া কমলাকান্তের বড় আনন্দ হইল!
শব্দার্থ ও টীকা
• চারপায়ী : টুল বা চৌকি
• প্রেতবৎ : প্রেতের মতো
• নেপোলিয়ন : ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (১৭৬৯-১৮২১) প্রায় সমগ্র ইউরোপে
নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছিলেন। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ওয়াটার্লু যুদ্ধে
ওয়েলিংটন ডিউকের হাতে পরাজিত হয়ে তিনি সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত হন
এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন
• ওয়েলিংটন : বীর যোদ্ধা, তিনি ডিউক অফ ওয়েলিংটন নামে পরিচিত (১৭৬৯ - ১৮৫৪),
ওয়াটার্লু যুদ্ধে তাঁর হাতে নেপোলিয়ন পরাজিত হন
• ডিউক : ইউরোপীয় সমাজের বনেদি বা অভিজাত ব্যক্তি
• মার্জার : বিড়াল
• ব্যূহ রচনা : প্রতিরোধ বেষ্টনী তৈরি করা, যুদ্ধের জন্য সৈন্য সাজানো
• প্রকটিত : তীব্রভাবে প্রকাশিত
• যষ্টি : লাঠি
• দিব্যকর্ণ : ঐশ্বরিকভাবে শ্রবণ করা
• ঠেঙ্গালাঠি : প্রহার করার লাঠি
• শিরোমণি : সমাজপতি, সমাজের প্রধান ব্যক্তি
• ন্যায়ালংকার : ন্যায়শাস্ত্রে পণ্ডিত
• ভার্যা : স্ত্রী, বউ
• সতরঞ্চ খেলা : নিচে (মাটিতে) বিছিয়ে যে খেলা খেলতে হয়, পাশা খেলা, দাবা খেলা
• লাঙ্গুল : লেজ, পুচ্ছ
• সোশিয়ালিস্টিক : সমাজতান্ত্রিক, সমাজের সবাই সমান-এমন একটি রাজনৈতিক মতবাদ
• নৈয়ায়িক : ন্যায়শাস্ত্রে পণ্ডিত ব্যক্তি
• কস্মিনকালে : কোনো সময়ে
• মার্জারী মহাশয়া : স্ত্রী বিড়াল
• জলযোগ : হালকা খাবার, টিফিন সরিষাভোর, ক্ষুদ্র অর্থে (উপমা)
• পতিত আত্মা : বিপদগ্রস্ত বা দুর্দশাগ্রস্ত আত্মা, এখানে বিড়ালকে বোঝানো হয়েছে
পাঠ-পরিচিতি
বঙ্কিমচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়ের রসাত্মক ও ব্যঙ্গধর্মী রচনার সংকলন ‘কমলাকান্তের দপ্তর’।
তিন অংশে বিভক্ত এই গ্রন্থে যে কটি গল্প আছে তার মধ্যে বিশেষভাবে
উল্লেখযোগ্য রচনা হলো ‘বিড়াল’। একদিন কমলাকান্ত নেশায় বুঁদ হয়ে ওয়াটার্লু
যুদ্ধ নিয়ে ভাবছিলেন। এমন সময় একটা বিড়াল এসে কমলাকান্তের জন্য রাখা
দুধটুকু খেয়ে ফেলে। ঘটনাটা বোঝার পর তিনি লাঠি দিয়ে বিড়ালটিকে মারতে উদ্যত
হন। মানুষের কাজ যারা অসহায় নিরন্ন তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া।
কিন্তু তারা তা করে না। ‘বিড়াল’ গল্পে বিড়ালকে তার প্রাপ্য খাদ্য থেকে
বঞ্চিত করা হয়েছে। সে তিন দিন না খেয়ে পরে দুধ চুরি করে খেয়ে ফেললেও
কমলাকান্ত তাকে মারতে পারেনি তার ক্ষুধার যন্ত্রণা নিজের অনুভূতিতে বিবেচনা
করে। এমনকি চুরি থেকে তাকে বিরত হওয়ার উপদেশ দিয়ে তার পরের দিনে জলযোগের
সময় ছানা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে কমলাকান্ত আনন্দবোধ করে। তখন কমলাকান্ত ও
বিড়ালটির মধ্যে কাল্পনিক কথোপকথন চলতে থাকে। এর প্রথম অংশ নিখাত
হাস্যরসাত্মক, পরের অংশ গূঢ়ার্থে সন্নিহিত। বিড়ালের কণ্ঠে পৃথিবীর সকল
বঞ্চিত, নিষ্পেষিত, দলিতের ক্ষোভ-প্রতিবাদ-কর্মবেদনা যুক্তিগ্রাহ্য
সাম্যতাত্ত্বিক সৌকর্যে উচ্চারিত হতে থাকে, ‘আমি চোর বটে কিন্তু আমি কি সাধ
করিয়া চোর হইয়াছি? খাইতে পাইলে কে চোর হয়? দেখ, যাঁহারা বড় বড় সাধু, চোরের
নামে শিহরিয়া ওঠেন, তাঁহারা অনেকে চোর অপেক্ষাও অধার্ম্মিক।’ মাছের কাঁটা,
পাতের ভাত-যা দিয়ে ইচ্ছে করলেই বিড়ালের ক্ষিধে দূর করা যায়। লোকজন তা না
করে সেই উচ্ছিষ্ট খাবার নর্দমায় ফেলে দেয়। যে ক্ষুধার্ত নয় তাকেই বেশি করে
খাওয়াতে চায়। ক্ষুধাকাতর-শ্রীহীনদের প্রতি ফিরেও তাকায় না। এমন ঘোরতর
অভিযোগ আনে বিড়ালটি। বিড়ালের ‘সোশিয়ালিস্টিক’, ‘সুবিচারিক’, ‘সুতার্কিক’
কথা শুনে বিস্মিত ও যুক্তিতে পর্যুদস্ত কমলাকান্তের মনে পড়ে আত্মরক্ষামূলক
শ্লেষাত্মক বাণী-বিজ্ঞ লোকের মতো এই যে, যখন বিচারে পরাস্ত হইবে তখন
গম্ভীরভাবে উপদেশ প্রদান করিবে এবং তিনি সেরকম কৌশলের আশ্রয় নাই
সাম্যাবাদবিমুখ, ইংরেজশাসিত ভারতবর্ষের একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়েও
বঙ্কিমচন্দ্র একটা বিড়ালের মুখ দিয়ে শোষক-শোষিত, ধনী-দরিদ্র, সাধু-চোরের
অধিকারবিষয়ক সংগ্রামের কথা কী শ্লেষাত্মক, যুক্তিনিষ্ঠ ও সাবলীল ভাষা ও
রূপকাশ্রয়ে উপস্থাপন করেছেন তা এ গল্প পাঠ করে উপলব্ধি করা যায়। এখানে লেখক
দুই শ্রেণির মানুষের স্বভাব-বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। এর মধ্যে কথকের
জবানিতে দুই শ্রেণির মানুষের স্ব স্ব পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। দুই
শ্রেণির একটিতে কথক নিজে এবং অন্যটিতে চোর বিড়াল। কথক নিজেকে সমাজের লোভী,
ধনাঢ্য শ্রেণির পর্যায়ে রেখে সমাজে ধনের বৃদ্ধি হওয়া কেনো জরুরি তা বিড়ালের
কাছে ব্যাখ্যা করেছেন।
0 মন্তব্যসমূহ