Advertisement

একাদশ - দ্বাদশ শ্রেণি : বাংলা ১ম পত্র মাসি-পিসি

 


লেখক পরিচিতি

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিহারের সাঁওতাল পরগনার দুমকায় ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯এ মে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতার নাম হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতার নাম নীরদাসুন্দরী দেবী। তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। ডাকনাম মানিক । বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে তিনি পড়াশোনা করেন।

মাত্র আটচল্লিশ বছর তিনি বেঁচেছিলেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএসসি পড়ার সময়ে মাত্র বিশ বছর বয়সে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’ লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। তাপর জীবনের বাকি আটাশ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখে গেছেন। মাঝে বছর তিনেক মাত্র তিনি চাকরি ও ব্যবসায়িক কাজে নিজেকে জড়ালেও বাকি পুরো সময়টাই তিনি সার্বক্ষণিকভাবে সাহিত্যসেবায় নিয়োজিত ছিলেন।

উপন্যাস ও ছোটগল্প লেখক হিসেবে মানিক বাংলা সাহিত্যে খ্যাতিমান। অল্প সময়েই তিনি সৃষ্টি করেছেন প্রায় চল্লিশটি উপন্যাস ও প্রায় তিনশ ছোটগল্প। সেই সঙ্গে লিখেছেন কিছু কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, ও ডায়েরি। বিজ্ঞানমনস্ক এই লেখক মানুষের জগৎ তথা অন্তর্জীবনের রূপকার হিসেবে সার্থকতা দেখিয়েছেন। একই সঙ্গে সমাজবাস্তবতার শিল্পি হিসেবেও সাক্ষর রেখেছেন। ‘জননী’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, পুতুলনাচের ইতিকথা’, ‘চিহ্ন’, প্রভৃতি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস। তাঁর বিখ্যাত ছোটগল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ‘প্রাগেতিহাসিক’, ‘সরিসৃপ’, ‘সমুদ্রের স্বদ’, ‘কুষ্ঠরোগীর বৌ’, ‘টিকটিকি’, ‘হলুদ পোড়া’, ‘আজকাল পরশুর গল্প’,‘হারানের নাসজামাই’, ‘ছোটবকুল পুরের যাত্রী’ প্রভৃতি।

কলকাতায় ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে তেসরা ডিসেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। 

মূলরচনা-১

শেষবেলায় খালে এখন পুরো ভাটা। জল নেমে গিয়ে কাদা আর ভাঙা ইটপাটকেল ও ওজনে ভারি আবর্জনা বেরিয়ে পড়ছে। কংক্রিটের পুলের কাছে খালের ধারে লাগানো সালতি থেকে খড় তোলা হচ্ছে পাড়ে। পাশাপাশি জোড়া লাগানো দুটো বড় সালতি বোঝাই আঁটিবাঁধা খড় তিনজনের মাথায় চড়ে গিয়ে জমা হচ্ছে ওপরের মস্ত গাদায়। ওঠানামার পথে ওরা খড় ফেলে নিয়েছে কাদায়। সালতি থেকে ওদের মাথায় খড় তুলে দিচ্ছে। দুজন। একজনের বয়স হয়েছে, আধপাকা চুল, রোগা শরীর। অন্যজন মাঝবয়সী, বেঁটে জোয়ান, মাথায় ঠাসা কদমছাটা রুক্ষ চুল।

পুলের তলা দিয়ে ভাটার টান ঠেলে এগিয়ে এল সরু লম্বার আরেকটা সালতি, দুহাত চওড়া হয়নি  না হয়। দুমাথায় দাড়িয়ে দুজন প্রৌঢ়া বিধবা লগি ঠেলছে, ময়লা মোটা থানের আঁচল দুজনেরই কোমরে বাঁধা। মাঝখানে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে অল্পবয়সী একটি বৌ। গায়ে জামা আছে, নকশা পাড়ের সস্তা সাদা শাড়ি। আঁটসাঁট থমথমে গড়ন, গোলগাল মুখ।

মাসি-পিসি ফিরছে কৈলেশ’ বুড়ো লোকটি বলল।

কৈলাশ বাহকের মাথায় খড় চাপতে ব্যস্ত চিল। চটপট শেষ আটিটা চাপিয়ে দিয়ে সে যখন ফিরল, মাসি পিসির সালতি দুহাতের মধ্যে এসে গেছেঃ।

ও মাসি, ওগো পিসি, রাখো রাখো। খপর আছে শুনে যাও।

সামনের দিকে লগি পুতে মাসি-পিসি সালতির গতি ঠেকায়, আহ্লাদি সিঁথির সিঁদুর পর্যন্ত ঘোমটা টেনে দেয়। সামনের থেকে মাসি বলে বিরক্তির সঙ্গে, বেলা আর নেই কৈলেশ। পেছনে থেকে পিসি বলে, অনেকটা যেতে হবে কৈলেশ। মাসি-পিসির গলা ঝরঝরে, আওয়াজ একটু মোটা, একটু ঝংকার আছে। কৈলাশের খবরটা গোপন, দুজনে লম্বা লম্বা সালতির দু-মাথায় থাকলে সম্ভব নয় চুপে চুপে বলা। মাসি বড় সালতির খড় ঠেকানো বাঁশটা চেপে ধরে থাকে, পিসি লগি হাতে নিয়েই পিছন থেকে এগিয়ে আসে সামনের দিকে। আহ্লাদি যেখানে ছিল সেখানে বসেই কান পেতে রাখে। কথাবার্তা সে রব শুনতে পায় সহজেই। কারণ, সে যাতে শুনতে পায় এমনি করেই বলে কৈলাশ।

মূলরচনা-২

বলি মাসি, তোমাকেও বলি পিসি, কৈলাশ শুরু  করে, মেয়াকে একদম শ্বশুরঘর পাঠাবে না মনে করেছ যদি, সে কেমন ধারা কথা হয়? এত বড় সোমত্ত মেয়া, তোমরা দুটি মেয়েলোক  বাদে ঘরে একটা পুরু ষমানুষ নেই, বিপদ-আপদ ঘটে যদি তো-

মাসি বলে, খুনসুটি রাখো দিকি কৈলেশ তোমার, মোদ্দাকথাটা কী তাই কও, বললে না যে খপর আছে কী? পিসি বলে, খপরটা  কী তাই কও। বেলা বেশি নেই কৈলেশ।

মাসি-পিসির সাথে পারা যাবে না জানে কৈলেশ। অগত্যা ফেনিয়ে রসিয়ে বলবার বদলে সে সোজা কথায় আসে, জগুর সাথে দেখা হলো কাল। খড় তুলে দিতে সাঁঝ হয়ে গেল, তা দোকানে এটটু-মানে আর কি চা খেতে গেছি চায়ের দোকানে, জগুর সাথে দেখা। মাসি বলে, সেথা ছাড়া আর ওকে কোথা দেখবে। হাতে দুটো পয়সা এলে তোমারও স্বভাব বিগড়ে যায় কৈলেশ। তা, কী বললে জগু?

কৈলেশ ফাঁপরে পড়ে আড়চোখে চায় আহ্লাদির দিকে, হঠাৎ বেমক্কা জোরের সঙ্গে প্রতিবাদ করে যে, তা নয়, পুলের কাছেই চায়ের দোকান, মাসি-পিসি গিয়ে জিজ্ঞাসা করুক না সেখানে। তারপরই জোর হারিয়ে বলে, ওসব এরকম ছেড়ে দিয়েছে জগু। লোকটা কেমন বদলে গেছে মাসি, সত্যি কথাপিসি, জগু আর সেই জগু নেই। বৌকে নিতে চায় এখন। তোমরা নাকি পণ করেছ মেয়া পাঠাবে না, তাতেই চটে আছে। সম্মান তো আছে একটা মানুষের, কবার নিতে এল তা মেয়া দিলে না, তাই তো নিতে আসে না আর। আমি বলি কী, নিজেরা যেচে এবার পাঠিয়ে দেও মেয়াকে।

মাসি বলে, পেটে শুকিয়ে লাথি ঝাঁটা খেতে? কলকেপোড়া ছ্যাঁকা খেতে? খুঁটির সাথে দড়িবাঁধা হয়ে থাকতে দিনভর রাতভর? মাসি বলে, মেয়া না পাঠাই, জামাই এলে রাখিনি জামাই-আদরে তাকে? ছাগলটা বেচে দিয়ে খাওয়াইনি ভালোমন্দ দশটা জিনিস?

মাসি বলে, ফের আসুক, আদরে রাখব যদ্দিন থাকে। বজ্জাত হোক, খুনে হোক, জামাই তো। ঘরে এলে খাতির না করব কেন? তবে মেয়া মোরা পাঠাবো না। বুড়ো রহমান একা খড় চাপিয়ে যায় বাহকদের মাথায়, চুপচাপ শুনে যায় এদের কথা। ছল ছল চোখে একবার তাকায় আহ্লাদির দিকে। তার মেয়েটা শ্বশুরবাড়িতে মরেছে অল্পদিন আগে। কিছুতে যেতে চায়নি মেয়েটা, দাপাদাপি করে কেঁদেছে যাওয়া ঠেকাতে, ছোট অবুঝ মেয়ে। তার ভালোর জন্যে তাকে জোর জবরদস্তি করে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আহ্লাদির সঙ্গে তার চেহারায় কোনো মিল নাই। বয়সে সে ছিল অনেক ছোট, চেহারা ছিল অনেক বেশি রোগা। তবু আহ্লাদির ফ্যাকাশে মুখে তারই মুখের ছাপ রহমান দেখতে পায়, খড়ের আঁটি তুলে দেবার ফাঁকে ফাঁকে যখনই সে তাকায় আহ্লাদির দিকে।

মূলরচনা-৩

কৈলাশ  বলে, তবে আসল কথাটা বলি। জগু মোকে বললে, এবার সে মামলা করবে বৌ নেবার জন্য । তার বিয়ে করা বৌকে তোমরা আটকে রেখে বদ মতলবে। মামলা করলে বিপদে পড়। সোয়ামি নিতে চাইলে বৌকে আটকে রাখার আইন নেই। জেল হয়ে যাবে তোমাদের। আর যেমন বুঝলাম, মামলা জগু করবেই আজকালের মধ্যে। মরবে তোমরা জান মাসি, জান পিসি, মারা  পড়বে তোমরা একেবারে।

আহ্লাদি একটা শব্দ করে, অষ্ফুট আর্তনাদের মতো। মাসি ও পিসি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে কয়েক বার। মনে হয়, মনে তাদের একই কথা উদয় হয়েছে, চোখে চোখে চেয়ে সেটা শুধু জানাজানি করে নিল তারা। মাসি বলল, জেলে নয় গেলাম কৈলেশ, কিন্তু মেয়া যদি সোয়ামির কাছে না যেতে চায় খুন হবার ভয়ে? বলে মাসি বড় সালতির খড় ঠোকনো বাঁশ ছেড়ে দিয়ে লগি গুঁজে দেয় কাদায়, পিসি তরতর করে পিছনে গিয়ে লগি কাদায় গুঁজে হেলে পড়ে শরীরের ভারে সরু লম্বা সালতিটাকে এগিয়ে দেয় ভাটার বিপক্ষে। বেলা একরম নাই। ছায়া নামছে চারদিকে। শকুনরা উড়ে এসে বসছে পাতাশূন্য শুকনো গাছটায়। একটা শকুন উড়ে গেল এ আশ্রয় ছেড়ে অল্প দূরে আরেকটা গাছের দিকে। ডাল ছেড়ে উড়তে আর নতুন ডালে গিয়ে বসতে কী তার পাখা ঝাপটানি! মায়ের বোন মাসি আর বাপের বোন পিসি বাপের ঘরের কেউ নেই আহ্লাদির। দুর্ভিক্ষ কোনোমতে ঠেকিয়েছিল তার বাপ। মহামারীর একটা রোগে, কলেরায়, সে, তার বৌ আর ছেলেটা শেষ হয়ে গেল। মাসি-পিসি তার আশ্রয়ে মাথা গুঁজে আছে অনেক দিন, দূর ছাই সয়ে আর কুড়িয়ে পেতে খেয়ে নিরাশ্রয় বিধবারা যেমন থাকে। নিজেদের ভরণপোষণের কিছু তারা রোজগার করত ধান ভেনে, কাঁথা সেলাই করে, ডালের বড়ি বেচে, হোগলা গেঁথে, শাকপাতা ফলমূল, ডাটা কুড়িযে এটাওটা জোগার করে। শাকপাতা, খুদকুঁড়ো ভোজন, বছরে দুজোড়া থান পরন-খরচ তো এই। বছরের পর বছর ধরে কিছু পুঁজি পযন্ত হয়েছিল দুজনের, রুপোর টাকা আধুলি সিকি। দুর্ভিক্ষের সময়টা বাঁচবার জন্য তাদের লড়তে হয়েছে সাংঘাতিকভাবে, আহ্লাদির বাপ তাদের থাকাটা শুধু বরাদ্দ রেখে খাওয়া ছাটাই করে দিয়েছি একেবারে পুরোপরি। তারও তখন বিষম অবস্থা। নিজেরা বাঁচে না, তার ওপর জগুর লাথির চোটে মরমর মেয়ে সে হাজির। সে কোনদিকে সামলাবে? মাসি-পিসির সেবা-যত্নেই আহ্লাদি অবশ্য সেবার বেঁচে গিয়েছিল, তার বাপ-মাও সেটা স্বীকার করেছে। কিন্তু কী করবে, গলা কেটে রক্ত দিয়ে সে ধার শোধ করা যদি-সম্ভব, অন্ন দেওয়ার ক্ষমতা কোথায় পাবে। পাল্লা দিয়ে মাসি-পিসি আহ্লদির জীবনের জন্য লড়েছিল, পেল যদি তো খেয়ে না-পেল যদি তো না খেয়েই। অবস্থা যখন তাদের অতি কাহিল, চারদিকে না-খেয়ে মরা শুরু করেছে মানুষ, মরণ ঠেকাতেই ফুরিয়ে আসছে তাদের জীবনীশক্তি; একদিন মাসি বলে পিসিকে, ‘একটা কাজ করবি বেয়াইন? তাতেও তোর দুটো পয়সা আসে, মোরও দুটো পয়সা আসে।’

মূলরচনা-৪

শহরের বাজারে তরিতরকারি ফলমূলের দাম চড়া। গাঁ থেকে কিনে যদি বাজারে গিয়ে বেচে আসে তারা, কিছু রোজগার হবে। একা মাসির ভরসা হয় না সালতি বেয়ে অতদূর যেতে, যাওয়া-আসাও একার দ্বারা হবে না তার। পিসি রাজি হয়েছিল। এতে কিছু হবে কি না হবে ভগবান জানে, কিন্তু যদি হয় তবে রোজগারের একটা নতুন উপায় মাসি পেয়ে যাবে আর সে পাবে না, তাকে না পেলে অন্য কারো সাথে হয় মাসি বন্দোবস্ত করবে, তা কি পারে পিসি ঘটতে দিতে।

সেই থেকে শুরু হয় গেরস্তের বাড়তি শাকসবজি ফলমূল নিয়ে মাসি-পিসির সালতি বেয়ে শহরের বাজারে গিয়ে বেচে আসা। গাঁয়ের বাবু বাসিন্দারাও নগদ পয়সার জন্য বাগানের জিনিস বেচতে দেয়।

মাসি-পিসির ভাব ছিল আগেও। অবস্থা এক বয়স সমান, একঘরে বাস, পরস্পরের কাছে ছাড়া সুখ-দুঃখের কথা তারা কাকেই-ই বলবে, কেই-বা শুনবে। তবে হিংসা দ্বেষ রেষারেষিও ছিল যথেষ্ট,  কোন্দলও বেধে যেত কারণে অকারণে। পিসি এ বাড়ির মেয়ে, এ তার বাপের বাড়ি। মাসি উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এখানে। তাই মাসির উপর পিসির একটা অবজ্ঞা অবহেলার ভাব চিল। এই নিয়ে পিসির অহংকার আর খোঁচাই সবেচেয়ে অসহ্য লাগত মাসির। ধীর শান্ত দুঃখী মানুষ মনে হতো এমনি তাদের কিন্ত ঝগড়া বাধলে অবাক হয়ে যেতে হতো তাদের দেখে। সে কী রাগ, সে কী তেজ, সে কী গোঁ! মনে হতো এই বুঝি কামড়ে দেয় একে অপরকে, এই বুঝি বঁটি দিয়ে।

শাকসবিজ বেচে বাঁচবার চেষ্টায় একসঙ্গে কোমর বেঁধে নেমে পড়ামাত্র সব বিরোধ সব পার্থক্য উড়ে গিয়ে দুজনের হয়ে গেল একমন, একপ্রাণ সে মিল জমজমাট হয়ে উঠল আহ্লাদির ভার ঘাড়ে পড়ায়। নিজের পেট ভরানো শুধু নয়, নিজেদের বেঁচে থাকা শুধু নয়, তাদের দুজনেরই এখন আহ্লাদি আছে। খাইয়ে পরিয়ে যত্নে রাখতে হবে তাকে, শ্বশুরঘরের কবল থেকে বাঁচাতে হবে তাকে, গাঁয়ের বজ্জাতদের নজর থেকে সামলে রাখতে হবে, কত দায়িত্ব তাদের, কত কাজ, কত ভাবনা।

বাপ-মা বেঁচে থাকলে আহ্লাদিকে হয়ত শ্বশুরবাড়ি যেতে হতো, মাসি-পিসিও বিশেষ কিছু বলতো কি না সন্দেহ। কিন্তু তারা তো নেই, এখন মাসি-পিসিরই সব দায়িত্ব। বিনা পরামর্শে আপনা থেকেই তাদের ঠিক হয়েছিল আহ্লাদিকে পাঠানো হবে না। আহ্লাদিকে কোথাও পাঠানোর কথা তারা ভাবতেও পারে না। বিশেষ করে ওই খুনেদের কাছে কখনো মেয়ে তারা পাঠাতে পারে, যাবার কথা ভাবলেই মেয়ে যখন আতঙ্কে পাঁশুটে মেরে যায়।

মূলরচনা-৫

বাপের ঘরদুয়ার জমিজমাটুকু আহ্লাদিকে বর্তেছে, জগুর বৌ নেবার আগ্রহও খুবই স্পষ্ট। সামান্যই ছিল তার বাপের তারও সিকিমতো আছে মোটে, বাকি গেছে গোকুলের কবলে। তবু মুফতে যা পাওয়া যায় তাতেই জগুর প্রবল লোভ।

খালি ঘরে আহ্লাদিকে রেখে কোথাও যাবার সাহস তাদের হয় না। দুজনে মিলে যদি যেতে হয় কোথাও আহ্লাদিকে তারা সঙ্গে নিয়ে যায়।

মাসি বলে, ডরাসনি আহ্লাদি। ভাঁওতা দিয়ে আমাদের দমাবার ফিকির সব। নয় তো কৈলেশকে দিয়ে   ওসব কথা বলায় মোদের?

পিসি বলে, ‘দুদিন বাদে ফের আসবে দেখিস জামাই। তখন শুধোলে বলবে, কই না, আমি তো ওসব কিছু বলি নি কৈলেশকে।’

মাসি বলে, ‘চার মাসে পড়লি আর কটা দিন বা। মা-মাসির কাছেই রইতে হয় এ সময়টা, জামাই এলে বুঝিয়ে বলব।’ পিসি বলে, ‘ছেলের মুখ দেখে পাষান নরম হয়, জানিস আহ্লাদি। তোর পিসে ছিল জগুর মতো। খোকাটা কোলে আসতে কী হয়ে গেল সেই মানুষ। চুপি চুপি এসে এটা ওটা খাওয়ায়, উঠতে বলি তো ওঠে, বসতে বলি বসে। মাসি বলে, তোর মেসো ঠিক ছিল, শাউড়ি ননদ ছিল বাঘ। উঠতে বসতে কী ছ্যাঁচা খেয়েছি ভাবলে বুক কাঁপে। কিন্তু জানিস আহ্লাদি, মেয়েটা যেই কোলে এলো শাউড়ি ননদ যেন মাকে মাথায় করে রাখলে বাঁচে। পিসি বলে, তুইও যাবি, সোয়ামির ঘর করবি। ডরাসনি, ডর কিসের?  বাড়ি ফিরে দীপ জ্বেলে মাসি-পিসি রান্নাবান্না সারতে লেগে যায়। বাইরে দিন কাটলেও আহ্লাদির পরিশ্রম কিন্তু হয়নি, শুয়ে বসেই দিন কেটেছে। তবু মাসি-পিসি কথায় সে একটু শোয়। শরীর নয, মনটা তার কেমন করছে। নিজেকে তার ছ্যাঁচড়া, নোংরা, নর্দমার মতো লাগে। মাসি-পিসির আড়লে থেকেও সে টের পায় কীভাবে মানুষের পর মানুষ তাকাচ্ছে তার দিকে, কতজন কতভাবে মাসি-পিসির সঙ্গে আলাপ জমাচ্ছে তরিতরকারির মতো তাকেও কেনা যায় কিনা যাচাই করবার জন্য । গাঁয়েরও কতজন তার কত রকমের দর দিয়েছে মাসি-পিসির কাছে। মাসি-পিসি চিনে তারা অনেকটা চুপচাপ হয়ে গেছে আজজাল, কিন্তু গোকুল হাল ছাড়েনি। মাসি-পিসিকে পাগল করে তুলেছে  গোকুল। মায়ের বাড়া তার এই মাসি-পিসি, কী দুর্ভোগ তাদের তার জন্য। মাসি-পিসিকে এত যন্ত্রণা দেওয়ার চেয়ে সে নয় শ্বশুরঘরের লাঞ্ছনা সইত, জগুর লাথি খেত। ঈষৎ তন্দ্রার ঘোরে শিউরে ওঠে আহ্লাদি। একপাশে মাসি আর একপাশে পিসিকে না নিয়ে শুলে কি চলবে তার  কোনোদিন?

মূলরচনা-৬

রান্নাক সেরে খাওয়ার আয়োজন করছে মাসি-পিসি, একেবারে ভাতটাত বেড়ে আহ্লাদিকে ডাকবে। ভাগাভাগি কাজ তাদের এমন সহজ হয়ে গেছে যে বলাবলির দরকার তাদের হয় না, দুজনে মিলে কাজ করে যেন একজনে করছে। এবার ব্যঞ্জনে নুন দেখে এ কথা বলতে হয় না পিসিকে, ঠিক সময়ে নুনের পাত্র সে এগিয়ে দেয় মাসির কাছে। বলাবলি করছে তারা আহ্লাদির কথা, আহ্লাদির সুখদুঃখ, আহ্লাদির সমস্যা, আহ্লাদির ভবিষ্যৎ। জামাই যদি আসে, একটু কড়া কথা তাকে বলা হবে না, এতটুকু খোঁচা দেওয়া হবে না। উপদেশ দিতে গেলে চটবে জামাই, পুরুষ মানুষ তো যতই হোক, এটা করা তার উচিত নয়, এসব কিছু বলা হবে না তাকে। জামাই এসেছে তাই রাখবার যেন ঠাঁই নেই এই ভাব খোবে মাসি-পিসি আহ্লাদিকে শিখিয়ে দিতে হবে সোয়ামি এসেছে বলে আহ্লাদে গদগদ হবা ভাব দেখায়। যে কদিন থাকে জামাই, সে যেন অনুভব করে, সে-ই এখানকার কর্তা, সে-ই সর্বেসর্বা।

বাইরে থেকে হাঁক আসে কানাই চৌকিদারের। মাসি-পিসি পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়, জোরে নিঃশ্বাস পড়ে দুজনের। সারাদা দিন গেছে লড়ে আর লড়ে। সরকার বাবুর সঙ্গে বাজারের তেলা নিয়ে ঝগড়া করতে অর্ধেক জীব বেরিয়ে গেছে দু-জনের । এখন এল চৌকিদার কানাই হাঙ্গামা না আসে রাত্রে, গাঁয়ে লোক যখন ঘমোচ্ছে।

রসুই চলায় ঝাঁপ এঁটে মাসি-পিসি বাইরে যায়। শুক্লপক্ষের একাদশীর উপোস করেছে তারা দুজনে গতকাল। আজ দ্বাদশী, জ্যোৎন্সা বেশ উজ্জ্বল। কানাইয়ের সাথে গোকুলের যে তিনজন পেয়াদা এসেছে তাদের মাসি-পিসি চিনতে পারে, মাথায় লাল পাগড়ি-আঁটা লোকটা তাদের অচেনা।

কানাই বলে, ‘কাছারিবাড়ি যেতে হবে একবার।’

মাসি বলে, ‘এত রাতে?’

পিসি বলে, ‘মরণ নেই?’

কানাই বলে, ‘দারোগাবাবু এসে বসে আছেন বাবুর সাথে যেতে একবার হবেগো দিদিঠাকরুনরা। বেঁধে নিয়ে যাবার হুকুম আছে।’

মাসি-পিসি মুখে মুখে তাকায়। পথের পাশে ডোবার ধারে কাঁঠাল গাছের ছায়ায় তিন চারজন ঘুপটি মেরে আছে। স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে মাসি-পিসি। ওরা যে গাঁয়ের গুণ্ডা সাধু বৈদ্য ওসমানেরা তাতে সন্দেহ নেই, বৈদ্যের ফেটি-বাধা বাবরি চুলওয়ালা মাথাটার পাতার ফাঁকে জ্যোৎস্না পড়েছে। তারা যাবে কাছারিতে কানাই আর পেয়াদা কনস্টেবলের সঙ্গে। ওরা এসে আহ্লাদিকে নিয়ে যাবে।

মাসি বলে, ‘মোদের একজন গেলে হবে না কানাই?’

পিসি বলে, ‘আমি যাই চলো?’

কর্তা ডেকেছেন দুজনকে।

মাসি-পিসি দুজনেই আবার তাকায় মুখে মুখে।

মাসি বলে, ‘কাপড়টা ছেড়ে আসি কানাই।’

পিসি বলে, ‘হাত ধুয়ে আসি, একদ-লাগবে না।’

মূলরচনা-৭

তাড়াতাড়িই ফিরে আসে তারা। মাসি নিয়ে আসে বঁটিটা হাতে করে, পিসির হাতে দেখা যায় রামদার মতো মস্ত একটা কাটারি। মাসি বলে, ‘কানাই, কত্তাকে বোলো, মেয়েনোকের এক রাতে কাছারিবাড়ি যেতে লজ্জা করে। কাল সকালে যাব।’ পিসি বলে, ‘এত রাতে মেয়েনোককে কাছাপিবাড়ি ডাকতে কত্তার লজ্জা করে না কানাই?’ কানই ফুসে ওঠে, ‘না যদি যাও ঠাকরুনরা ভালোয় ভালোয়, ধরে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবার হুকুম আছে কিন্তু বলে রাখলাম।’ মাসি বঁটিটা বাগিয়ে ধরে দাঁতে দাঁত কামড়ে বলে বটে? ধরে বেঁধে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাবে? এসো। কে এগিয়ে আসবে এসো। বাঁটির এক কোপে গলা ফাঁক করে দেব। পিসি বলে, আয় না বজ্জাত হারামজাদা, এগিয়ে আয় না? কাটারির কোপে গলা কাটি দু-একটার। দু-পা এগোয় তারা দ্বিধাভরে। মাসি-পিসির মধ্যে ভয়ের লেশটুক না দেখে সত্যিই তারা খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছে। মারাত্বক ভঙ্গিতে বঁটি আর দা উঁচু হয় মসি-পিসির। মাসি  বলে, শোনো কানাই, এ কিন্তু এর্কি নয় মোটে। তোমাদের সাথে মোরা মেয়েনোক পারব না জানি কন্তিু দুটো একটাকে মারব জখন করব ঠিক। তারপর বিনা পরামর্শে মাসি-পিসি হঠাৎ গলা ছেড়ে দেয়। প্রথমে শুরু করে মাসি, তারপর যোগ দেয় পিসি। আশপাশে যত বাসিন্দা আছে সকলের নাম ধরে গলা ফাটিয়ে তারা হাঁক দেয়, ও বাবাঠাকুর! ও ঘোষ মশায়! ও জনাদ্দন! ওগো কানুর মা! বিপিন! বংশী কানাই অদৃশ্য হয়ে যায় দলবল নিয়ে। হাকাহাঁকি ডাকাডাকি শুরু হয়ে যায় পাড়ায়, অনেকে ছুটে আসে, কেউ কেউ ব্যাপার অনুমান করে ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দেয় বাইরে না বেরিয়ে। এই হট্টগোলের পর আরও নিঝুম আরও থমথমে মনে হয় রাত্রিটা। আহ্লাদিকে মাঝখানে নিয়ে শুয়ে ঘুম আসে না মাসি-পিসির চোখে। বিপদে পড়ে হাঁক দিলে পাড়ার এত লোক ছুটে আসে, এমনভাবে প্রাণ খুলে এতখানি জ্বালার সঙ্গে নিজেদের মধ্যে খোলাখুলিভাবে গোকুল আর দারোগা ব্যাটার চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করতে সাহস পায়, জানা ছিল না মাসিপিসির। তারা হাঁকডাক শুরু করেছিল খানিকটা কানাইদের ভড়কে দেবার জন্যে, এত লোক এসে পড়বে আশা করেনি। তাদের জন্য যতটা নয়, গোকুল আর দারোগার ওপর রাগে জ্বালাই যেন ওদের ঘর থেকে টেনে বার করে এনেছে মনে হলো সকলের কথাবার্তা শুনে। কেমন একটা স্বস্তি বোধ করে মাসি-পিসি। বুকে নতুন জোর পায়। মাসি, বলে, জানো বেয়াইন, ওরা ফের ঘুরে আসবে মন বলছে। এত সহজে ছাড়বে কি। পিসি বলে, তাই ভাবছিলাম। মেয়েটাকে কুটুমবাড়ি সরিয়ে দেওয়ায় সোনাদের ঘরে মাঝরাতে আগুণ ধরিয়েছিল সেবার খানিক চুপচাপ ভাবে দুজনে। মাসি  বলে, সজাগ রইতে হবে রাতটা। পিসি বলে, তাই ভালো কাঁথা কম্বলটা চুবিয়ে রাখি জলে কী জানি কী হয়। আস্তে চুপি চুপি তারা কথা কয়, আহ্লাদির ঘুম না ভাঙ্গে। অতি সন্তর্পণে তারা বিছানা ছেড়ে ওঠে। আহ্লাদির বাপের আমলের গোরুটা নেই, গামলাটা আছে। ঘড়া থেকে জল ঢেলে মোটা কাঁথা আর পুরনো ছেঁড়া একটা কম্বল চুবিয়ে রাখে, চালায় আগুন ধরে উঠতে উঠতে গোড়ায় চাপা দিয়ে নেভানো যাতে সহজ হয়। ঘড়ায় আর হাঁড়ি কলসিতে আরও জল এনে রাখে তারা ডোবা থেকে। বঁটি আর দা হাতের কাছেই যুদ্ধের আয়োজন করে তৈরি হয়ে থাকে মাসি-পিসি।

শব্দার্থ ও টীকা

– সালতি - শালকাঠি নির্মিত বা তালকাঠের সরু ডোঙা।

– বদম ছাঁট- মাথার চুল এমনভাবে ছাঁটা যে তা কদমফুলের আকার ধারণ করে।

– লগি - হাত ছয়েক লম্বা সরু  বাঁশ । নৌকা চালানোর জন্য ব্যবহৃত বাঁশের দণ্ড।

– খপর - ‘খবর’ শব্দের আঞ্চলিক উচ্চারণ।

– মেয়া - মেয়ে শব্দের আঞ্চলিক উচ্চারণ।

– সোমত্ত - সামর্থ (সংসারধর্ম পালনে), যৌবনপ্রাপ্ত

– খুনসুটি - হাসি তামাশাযুক্ত বিবাদ-বিসম্বাদ বা ঝগড়া

– বেমক্কা - স্থান-বহির্ভূত। অসংগত ।

– পেটে শুকিয়ে লাথি ঝাঁটা-পর্যাপ্ত খাবার না-জুগিয়ে কষ্ট দেওয়ার পাশাপাশি লাথি ঝাঁটার মাধ্যমে শারীরিকভাবে নির্যাতন।

– কলপোড়া ছ্যাঁকা-তামাকসেবনে ব্যবহৃত হুঁকার উপরে কলকেতে থাকে যে আগুন তা দিয়ে দগ্ধ করা।

– ডালের বড়ি- চালকুমড়া ও ডাল পিশে ছোট ছোট আকারে তৈরি করা খাদ্যবস্তু যা রোদে  শুকিয়ে – সংরক্ষণ করা  হয় এবং সবজি মাছ-মাংসের সঙ্গে রান্না করে খাওয়া হয়।

– পাঁশুটে - ছাইবর্ণবিশিষ্ট। পাংশুবর্ণ। পাণ্ডুর । ফ্যাকাশে।

– সড়গড় - রপ্ত। মুখস্থ।  অভ্যস্থ। স্মৃতিগত।

– ব্যঞ্জন - রান্না-করা তরকারি

– বাজারের তোলা - বাজারে বিক্রেতাদের  কাছ থেকে আদায় করা খাজনা।

– কাটারি - কাটবার অস্ত্র।

– এর্কি – ‘ইয়ার্কি’ শব্দের আঞ্চলিক উচ্চারণ। হাস্য-পরিহাস বা রসিকতা।

পাঠ-পরিচিতি

‘মাসিপিসি’ গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় কলকাতার ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় ১৩৫২ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায় (মার্চ-এপ্রিল ১৯৪৬)। পরে এটি সংকলিত হয় ‘পরিস্থিতি’ (অক্টোবর ১৯৪৬) নামক গল্পগ্রন্থে। বর্তমান পাঠ গ্রহণ করা হয়েছে ‘ঐতিহ্য’ প্রকাশিত মানিক-রচনাবলি পঞ্চম খণ্ড থেকে।

স্বামীর নির্মম নির্যাতনের শিকার পিতৃমাতৃহীন এক তরুণীর করুন জীবনকাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে ‘মাসি-পিসি’ গল্প। আহ্লাদি নামক ওই তরুণীর মাসি ও পিসি দুজনই বিধবা ও নিঃস্ব। তারা তাদের অস্তিত্বরক্ষার পাশাপাশি বিরূপ বিশ্ব থেকে আহ্লাদিকে রক্ষার জন্য যে বুদ্ধিদীপ্ত ও সাহসী সংগ্রাম পরিচালনা করে সেটাই গল্পটিকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। অত্যvচারী স্বামী এবং লালসা-উন্মত্ত জোতদার, দারোগা ও গুণ্ডা-বদমাশদের আক্রমণ থেকে আহ্লাদিকে নিরাপদ রাখার ক্ষেত্রে অসহায় দুই বিধবার দায়িত্বশীল ও মানবিক জীবনযুদ্ধ খুবই প্রশংসনীয়। দুর্ভিক্ষের মর্মস্পর্শী স্মৃতি, জীবিকা নির্বাহের কঠিন সংগ্রাম, নারী হয়ে নৌকাচালনা ও সবজির ব্যবসায় পরিচালনা প্রভৃতি এ গল্পের বৈচিত্র্যময় দিক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ