Advertisement

আল্লাহর জিকির কেন ও কিভাবে করব

 


মুয়াবিয়া (রা.) বলেন, ‘একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) বের হয়ে সাহাবিদের এক মজলিসে পৌঁছলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের এখানে কিসে বসিয়েছে? তাঁরা বললেন, আমরা আল্লাহর স্মরণে এবং তিনি যে আমাদের হেদায়াত দান করেছেন, আপনাকে প্রেরণ করে আল্লাহ আমাদের ওপর যে অনুগ্রহ করেছেন তার কৃতজ্ঞতা আদায় করতে বসেছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি কি তোমরা এ জন্য এখানে বসেছ? তাঁরা বললেন, আল্লাহর শপথ! আমরা এ জন্যই এখানে সমবেত হয়েছি। তিনি বললেন, আমি তোমাদের মিথ্যাবাদী মনে করে থেকে শপথ নিইনি, বরং এ জন্য নিয়েছি যে জিবরাইল (আ.) এসে আমাকে সংবাদ দিয়েছেন আল্লাহ তাআলা তোমাদের ব্যাপারে ফেরেশতাদের ওপর গর্ব করেছেন।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৫৪২৬)

আলোচ্য হাদিসে আল্লাহর স্মরণ বা জিকিরকারীদের উচ্চ মর্যাদা ও তার প্রতিদান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

 

আল্লাহর স্মরণ বা জিকির কী?

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো সম্প্রদায় আল্লাহর কোনো ঘরে সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে, পরস্পর তা নিয়ে আলোচনা করে, তখন তাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হয় এবং রহমত তাদের ঢেকে নেয়, ফেরেশতারা তাদের ঘিরে রাখে আর আল্লাহ তাঁর নিকটবর্তী ফেরেশতাদের কাছে তাদের প্রশংসা করেন।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১৪৫৫)

উল্লিখিত হাদিসের আলোকে মুহাদ্দিসরা বলেন, আল্লাহর যে কোনো ধরনের আনুগত্য ও ইবাদত, আল্লাহর নাম ও তাঁর গুণাবলির উচ্চারণ, কোরআন তিলাওয়াত ও ধর্মীয় আলোচনাগুলো আল্লাহর স্মরণের অন্তর্ভুক্ত। তবে সাধক আলেমরা তাঁদের অনুসারীদের অবস্থা বিবেচনায় বিশেষ জিকির ও তাসবিহ পাঠের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত এসব জিকির ও তাসবিহ আল্লাহর স্মরণ হিসেবে গণ্য।

 

আল্লাহর স্মরণে উভয় জগতের মর্যাদা বৃদ্ধি

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘কেউ সম্মান ও ক্ষমতা চাইলে সে জেনে রাখুক সব ক্ষমতা ও সম্মান আল্লাহরই। তাঁর দিকে পবিত্র বাণীগুলো সমুত্থিত হয় এবং নেক আমল তাকে উন্নীত করে। আর যারা মন্দ কাজের ফন্দি আঁটে, তাদের জন্য আছে কঠিন শাস্তি। তাদের ফন্দি ব্যর্থ হবেই।’ (সুরা : ফাতির, আয়াত : ১০)

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘এখানে পবিত্র বাণীর উদ্দেশ্য জিকির, তিলাওয়াত ও দোয়া।’ তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইহকাল ও পরকালে প্রিয়ভাজন হতে চায়, তার জন্য আল্লাহর আনুগত্য আবশ্যক। কেননা আল্লাহই তার উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারেন। তিনিই ইহকাল ও পরকালের মালিক এবং সব সম্মান আল্লাহর জন্য।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)

 

আল্লাহর স্মরণে মুমিনের প্রশান্তি

মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা ঈমান আনে, আল্লাহর স্মরণে তাদের অন্তর প্রশান্ত হয়। জেনে রেখো, আল্লাহর স্মরণেই শুধু হৃদয় প্রশান্ত হয়।’ (সুরা : রাদ, আয়াত : ২৮)

উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহর জিকির ও স্মরণকে মুমিনের হৃদয়ের প্রশান্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং মুমিন ঈমানের দাবি হিসেবেই মহান আল্লাহর জিকির ও স্মরণ করবে।

 

জিকিরের পদ্ধতি

জিকির বা আল্লাহর স্মরণের তিনটি পদ্ধতি আছে—এক. আধ্যাত্মিক জিকির, যে জিকির কল্পনা ও চিন্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তাতে জিহ্বার সামান্য স্পন্দনও হয় না। দুই. যে জিকিরে আত্মার কল্পনার সঙ্গে সঙ্গে জিহ্বাও নড়বে। তবে তা-ও আওয়াজ অন্যরা শুনতে পাবে না। তিন. অন্তরে উদ্দিষ্ট সত্তার উপস্থিতি ও ধ্যান করার পাশাপাশি জিহ্বার স্পন্দনও হবে এবং সেই সঙ্গে শব্দও বের হবে। সরব ও নীরব জিকিরের মধ্যে কোনটি উত্তম, তার ফায়সালা অবস্থাভেদে বিভিন্ন রকম হতে পারে। কারো জন্য জোরে আর কারো জন্য আস্তে জিকির করা উত্তম। (https://bit.ly/3cbuABD)

 

জিকিরের উত্তম পদ্ধতি

কোরআন ও হাদিসের বহু স্থানে আল্লাহর জিকির করার প্রতি বিশেষ তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জিকির আস্তে করবে, না জোরে করবে, তা নিয়েও আলেমদের মধ্যে মতভিন্নতা আছে। তবে সুরা আরাফের ৫৫ নম্বর আয়াত দ্বারা ‘আস্তে জিকির’ উত্তম প্রমাণিত হয়। এ ছাড়া খায়বর যুদ্ধে সাহাবিরা তাকবির ধ্বনি উচ্চৈঃস্বরে হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হে মানুষ, নরম হও, বিনম্র আওয়াজে আল্লাহকে ডাকো...তোমরা বধির বা অনুপস্থিত কাউকে ডাকছ না।’ (সহিহ মুসলিম) (https://bit.ly/3cbuABD)

তবে কোনো শায়খ যদি তাঁর কোনো মুরিদ বা অনুসারীর অবস্থা বিবেচনা করে উচ্চৈঃস্বরে জিকির করার নির্দেশ দেন, তখন মুরিদ তাকে নিজের আধ্যাত্মিক চিকিৎসার অংশ মনে করে তার অনুসরণ করবে। কেননা সাহাবায়ে কিরাম ও পূর্ববর্তীদের আলেমদের থেকে উচ্চৈঃস্বরে জিকিরও প্রমাণিত।

 

জিকির কবুল হওয়ার শর্ত

উল্লিখিত আয়াতের ‘নেক আমল তাকে উন্নীত করে’ বাক্যের ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করে অথচ ফরজ ইবাদত করে না, তার জিকির প্রত্যাখ্যাত হয়। কেননা ফরজ ইবাদত তার প্রথম দায়িত্ব।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির) আলোচ্য আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় ফরজ ইবাদত পালন তথা ইসলামী শরিয়তের আনুগত্য ছাড়া শুধু আল্লাহর জিকির ও ধ্যান গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা ব্যক্তির পরকালীন মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়, বরং মুমিন ইসলামের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত বিধান পরিপালনের পাশাপাশি আল্লাহর জিকির ও স্মরণে মনোযোগী হবে।

 

জিকির না করার ক্ষতি

আবু মুসা আশয়ারি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যারা আল্লাহর জিকির করে এবং যারা আল্লাহর জিকির করে না, তাদের দৃষ্টান্ত জীবিত ও মৃত ব্যক্তির মতো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৪০৭)

উল্লিখিত হাদিসে মহানবী (সা.) আল্লাহর স্মরণবিমুখ মানুষকে মৃত ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন। পবিত্র কোরআনে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আমার স্মরণে বিমুখ থাকবে, অবশ্যই তার জীবনযাপন হবে সংকুচিত। আর তাকে কিয়ামতের দিন উঠাব অন্ধ করে।’ (সুরা : ত্বহা, আয়াত : ১২৪)

আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, আল্লাহর স্মরণে বিমুখ হওয়ার অর্থ হলো কারো সামনে আল্লাহর স্মরণ হওয়ার পর তা উপেক্ষা করা, গ্রহণ না করা, তাতে সাড়া না দেওয়া এবং তা দ্বারা উপদেশ গ্রহণ না করা। এমন ব্যক্তি সম্মান-মর্যাদা, আবাস ও জীবনযাপনে সংকীর্ণতার মুখোমুখি হবে। (তাফসিরে ইবনে কাসির) আল্লাহ সবাইকে বেশি বেশি জিকির করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ